ভ্যালেন্টাইন ডে: ইতিহাস, তাৎপর্য, স্বীকৃতি, পালন করা উচিত কিনা, বাইবেলীয় ভালোবাসা।
ভ্যালেন্টাইন ডে যা বাংলায় ভালোবাসা দিবস বলা হয় এই নিয়ে এই নিবন্ধটি পুরো পড়বেন। কারণ এই নিবন্ধে এই নিয়ে সহজ সরল বাংলা ভাষায় ধারণা দেওয়া হয়েছে। ভ্যালেন্টাইন ডে প্রতি বছর ১৪ ফ্রেব্রুয়ারিতে বিশ্বজুড়ে পালন করা হয়। এটি সাধারণত প্রেম, স্নেহ এবং ভালোবাসা প্রকাশ করার বিশেষ দিন জানা যায়। তবে এই দিনটি খ্রিস্টানদের জন্য কতটা ঠিক না ভুল! এবং বাইবেলের হিসেবে এর কি গুরুত্ব রয়েছে, এই নিয়ে খ্রিস্টানদের মধ্যে অনেকের মনে প্রশ্ন নাড়া দিয়ে থাকে। এই নিবন্ধে আমরা ভ্যালেন্টাইন ডে'র ইতিহাস এবং খ্রীষ্টিয় পরিপ্রেক্ষিতে এবং বাইবেলের আলোকে ভ্যালেন্টাইন ডে'র অভিপ্রায় ফয়সালা আলোচনা করব।
ভ্যালেন্টাইন ডে এর ইতিহাস
ভ্যালেন্টাইন ডে উৎপত্তি নিয়ে বেশ কিছু প্রচলিত কাহানি রয়েছে। সবথেকে বেশি প্রচলিত কাহানি হল রোমান ক্যাথলিকদের সাধু ভ্যালেন্টাইন কে নিয়ে। তৃতীয় শতাব্দীতে সম্রাট ক্লোডিয়াস শাসনকালে একজন রোমান ক্যাথলিক পাদ্রী ছিলেন। বলা হয় সম্রাট ক্লোডিয়াস সৈনিকদের বিবাহ নিষিদ্ধ করেছিলেন। সম্রাট ক্লোডিয়াস বিশ্বাস করতেন যে বিবাহিত পুরুষরা সৈনিক জন্য যথার্থ নয় তাই তিনি যুবকদের বিবাহ নিসিদ্ধ করেন। সম্রাটের এই কথা রোমান ক্যাথলিক পাদ্রী ঘোর বিরোধিতা ছিলেন। তিনি এই কথা উপযুক্ত বলে মনে করতেন না। ফলে তিনি ওই সৈনিকদের যারা একের অপরকে ভালোবাসতো তাদের গোপনে বিবাহ করিয়ে দিয়ে দিতেন। অর্থাৎ তিনি গোপনে যুবক - যুবতীদের বিবাহ দেওয়া চালিয়ে যান। ফল স্বরূপ সম্রাট ক্লোডিয়াস সাধু ভ্যালেন্টাইন কে গ্ৰেফতার করার আদেশ দেন এবং পরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মৃত্যুর আগে তিনি কারাগারে থাকাকালীন একজন যুবতী কে ভালোবাসতেন। ওই যুবতীর প্রতি শেষ ভালবাসার চিরকুট লিখে ছিলেন, যেখানে এভাবে লেখা ছিল; তোমার ভ্যালেন্টাইন। বর্তমান এই কাহিনীটি ভ্যালেন্টাইন ডে সাথে জড়িয়ে যায় যেটি ভালোবাসা ও ত্যাগের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
ভ্যালেন্টাইন ডে স্বীকৃতি
প্রাচীন রোম উৎসব যেটি “লুপারকালিয়া/লুপারসালিয়া” নামে পরিচিত। যা ফ্রেব্রুয়ারি মাসে পালন করা হয় যেটি উর্বরতার এবং যৌনতার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত ছিল। পরে এটি রোমান ক্যাথলিক পোপ বা বিশপ গেলাসিয়া প্রথম দ্বারা ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে ভ্যালেন্টাইন ডে সূচনা হয়।
ভ্যালেন্টাইন ডে: খ্রিস্টানদের জন্য তাৎপর্য
খ্রিস্টানদের মধ্যে ভ্যালেন্টাইন ডে এর তাৎপর্য নিয়ে খুবই তর্কবিতর্ক রয়েছে। কিছু খ্রিস্টান বিশেষ করে বলা যায় যে রোমান ক্যাথলিক এই দিনটিকে ভালোবাসা ও ত্যাগের প্রতীক হিসেবে দেখেন তাই এটিকে প্রচুর আড়ম্বর সহিত পালন করেন। রোমান ক্যাথলিকরা বিশ্বাস করেন যে ভ্যালেন্টাইনস ডে এর মধ্যে দিয়ে তারা ঈশ্বরের ভালবাসা এবং মানুষের মধ্যে পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা প্রকাশ করতে পারে। অন্যদিকে কিছু খ্রিস্টান বিশেষ করে তারা যারা প্রকৃত পক্ষে বাইবেল নিয়ে চলে। তারা মনে করে এই দিনটি পৌলিক উৎসব যেখানে প্রেম নামে যৌনতার ব্যাভিচার করা হয়। তাই এটি পালন করা থেকে দূরে থাকেন। তারা মনে করেন যে এটি কোনো খ্রীষ্টিয় উৎসব নয়। বরং এটি প্রাচীন রোমান উৎসব। তাই ওই প্রকৃত খ্রিস্টান এই দিন তারা খ্রীষ্টিয় বিশ্বাসের অনুকূল মনে করে না।
ভ্যালেন্টাইন ডে এবং বাইবেলীয় ভালোবাসা
ভ্যালেন্টাইন ডে - এর মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ করা এটি একটি ভালো প্রচেষ্টা হয়তো হতে পারে, কিন্তু তবুও এটি বাইবেলীয় ভালোবাসার সাথে কতটা অনুকূল তা দেখা প্রয়োজন।
- ভ্যালেন্টাইন ভালোবাসা: যেখানে একজন প্রিয়তমার প্রতি ভালোবাসা বহিঃপ্রকাশ দেখায়, যেখানে বর্তমান দিনে মোবাইলের এসএমএস (SMS) মাধ্যমে বা উপহার মাধ্যমে বা কার্ডের মাধ্যমে হতে পারে। পরবর্তীতে সেই বহিঃপ্রকাশ এক যৌন ক্রিয়ার অভিমুখীতা হয়ে ওঠে।
- বাইবেলীয় ভালোবাসা: এই ভালোবাসা শুধু মাত্র রোমান্টিক ভালোবাসার মধ্যে সিমাবদ্ধ নয়, এই রোমান্টিক ভালোবাসা বিয়ের আগে অনুচিত বা পাপ/ ব্যভিচার (১ তীমথিয় ৪:১২; ইব্রীয় ১৩:৪)। বাইবেলীয় ভালোবাসা এটি ব্যাপক ও গভীর। এটি ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা, পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের প্রতি ভালোবাসা এমনকি শত্রুদের প্রতি ভালোবাসাকেও দেখায় (১ যোহন ৫:৩; দ্বিতীয় বিবরণ ৫:১০; যোহন ১৩:৩৪; ১ তীমথিয় ৫:৮; যোহন ১১:১ - ৩৬; মথি ৫:৪৪)।
ভ্যালেন্টাইন ডের মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ করা হয়ত একটি সুযোগ হতে পারে, তবে এটি শুধুমাত্র একটি দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা উচিত নয়। বাইবেল আমাদেরকে প্রতিদিন ভালোবাসা প্রকাশ করতে উৎসাহিত করে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে ভ্যালেন্টাইন ডে'র ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য উৎসাহিত করে না। বাইবেলীয় ভালোবাসা এটি আমাদের কথায় কাজে এবং আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ করার অনুপ্রেরণা যোগায়।
খ্রিস্টানদের জন্য ভ্যালেন্টাইন ডে পালন করা উচিত কিনা?
এই বিষয়ের উত্তর নিজে থেকে জটিল বলা যেতে পারে, কারণ এই প্রশ্নের উত্তর ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও বিবেকের উপরে নির্ভর করে। কিন্তু যে খ্রিস্টানরা এই দিনটিকে ভালোবাসা ও ত্যাগের প্রতীক হিসাবে দেখেন এবং এটি পালন করেন। এই হিসাবে বলা যেতে পারে যে এটি অনুচিত। কারণ এই দিনটি এমন কিছু হয়েছিল বাইবেল হিসেবে তা কিন্তু নয়। বা বাইবেল ভ্যালেন্টাইন ডে পালন করার আদেশ দিয়েছে তাও কিন্তু নয়। কিন্তু অন্যদিকে যেই খ্রিস্টান এই দিন পৌওলিক উৎসবের সাথে জড়িত দেখেন আর পালন করে না সেই হিসেবে ঠিক বলা যেতে পারে। কারণ এটি পৌওলিক উৎসবের উৎস ছিলো।
বাইবেলের দৃষ্টিতে ভালোবাসা
ভালোবাসা হল; খ্রীষ্টিয় বিশ্বাসের একটি কেন্দ্রবৃন্দু/ কেন্দ্রস্থল। কারণ বাইবেল ভালোবাসাকে ঈশ্বরের সবচেয়ে বড় গুণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ১ করিন্থীয় ১৩ অধ্যায়ে ঈশ্বরের ভালোবাসা বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়েছে, যেখানে এইভাবে বলা হয়েছে যে; “ভালোবাসায় ধৈর্যশীল, দয়ালু, ঈর্ষা করে না, গর্ব করে না, অহংকারী হয় না, অসদাচরণ করে না, স্বার্থপর হয় না, সহজে রাগ করে না, মন্দকে মনে রাখে না, সত্যে আনন্দিত হয়, সবকিছু সহ্য করে, সবকিছু বিশ্বাস করে, সবকিছু আশা করে, এবং সবকিছু সহ্য করে।”
বাইবেল হিসেবে ভালোবাসা শুধুমাত্র মানবিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি ঈশ্বরের প্রতি আমাদের ভালোবাসা এবং প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসার সাথে সংযুক্ত। তাই তো স্বয়ং ঈশ্বর যীশু বলেছেন; “তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসো যেমন আমি তোমাদেরকে ভালোবেসেছি” (যোহন ১৫:১২)। এই ভালোবাসা শুধুমাত্র আবেগ বা অনুভূতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি কর্মের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তাই বাইবেল বারবার শতবার ভালোবাসার বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকে (১ পিতর ৪:৪; হিতোপদেশ ১০:১২; ১ যোহন ৩:১১; রোমীয় ১৩:১০; ১ থিষলনীকীয় ৪:৯; ১ তীমথিয় ৬:১১; মার্ক ১২:৩৩; রোমীয় ১২:১০; গীত ৮৯:২; কলসীয় ৩:১৩)।
উপসংহার
ভ্যালেন্টাইন ডের মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ করা হয়তো এটি একটি মাধ্যম হতে পারে। তবে বাইবেলীয় ভালবাসার সাথে কতটা ভ্যালেন্টাইন ডে অনুকূল তা বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। বাইবেল আমাদেরকে প্রতিদিন ভালোবাসা প্রকাশ করতে উৎসাহিত করে এবং একটি শুধুমাত্র একটি বিশেষ দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। খ্রিস্টানদের জন্য ভ্যালেন্টাইন ডে পালন করা উচিত কিনা তা ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও বিবেক এর উপর নির্ভর করে। যে কোনদিনই হোক না কেন ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরের ভালোবাসা এবং মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি। ভালোবাসা শুধু মাত্র একটি আবেগ নয় বরং এটি একটি জীবনযাপনের অংশ। পাশাপাশি আমাদের প্রতিদিন ভালোবাসা প্রকাশ করা উচিত। তবে ভ্যালেন্টাইন ডে'র মাধ্যমে যুবক - যুবতীদের সাহায্য কি ঈশ্বরের মহিমা হয়। যদি হয় তা কিভাবে ঈশ্বরের মহিমা হয় তাও বিবেচনা করা উচিত। পরিস্কার ভাষায় বলা যে তা অনুচিত কারণ বিয়ে করার আগে কোনো ভাবে যুবক- যুবতীদের এক হওয়া উচিত নয়।
0 মন্তব্যসমূহ