ভ্যালেন্টাইন ডে: ইতিহাস, তাৎপর্য ও উদযাপন
ভ্যালেন্টাইন ডে, বছরে একটি যা বিশ্বজুড়ে ইংরেজি মাসে ফ্রেব্রুয়ারি ১৪ তারিখ পালন করা হয়। বলা যায় এই দিনটি ভালোবাসার প্রেমিক/ প্রেমিকাদের ভালোবাসা প্রকাশ করা জন্য একটি স্পেশাল দিন। তা বলে এটি শুধুমাত্র প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্যই তাও কিন্তু নয়, এই দিন তা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পরিবার এবং কাছের মানুষদের মধ্যে ভালোবাসা বিলিয়ে দেওয়ার একটি বিশেষ দিন। নিঃসন্দেহে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন পরিবার এবং কাছের মানুষদের থেকে অধিক এই দিন প্রেমিক প্রেমিকাদের কাছে এই দিনটি বিশেষ একটা স্পেশাল দিন। ভ্যালেন্টাইন ডে কি? ভ্যালেন্টাইন ডে কখন কীভাবে শুরু হয়েছিল? এবং এর ইতিহাস কী? এবং কেন এটি পালন করা হয়? এই সব বিষয়বস্তুর সম্পর্কে জানার জন্য আর্টিকেল দেখুন।
ভ্যালেন্টাইন ডের ইতিহাস
আমাদের ভ্যালেন্টাইন ডের ইতিহাস জানতে হলে প্রথমে আমাদের এই বিষয়বস্তুর উৎস জানতে হবে। ভ্যালেন্টাইন ডের ইতিহাস বেশ রহস্যময় এবং এর পেছনে বেশ কয়েকটি কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে যেমন;
- সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কাহিনী।
- রোমানদের প্রাচীন উৎসব লুপারকালিয়া।
এই দিনটির উৎপত্তি প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে যেহেতু পরবর্তীতে রোমানরা খ্রিস্টীয় ধর্ম অনুসরণ করেছিলো তাই খ্রীষ্টিয় ধর্মের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায়।
1. সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কাহিনী
ভ্যালেন্টাইন ডের নামকরণ হয় খ্রিস্টানদের এক সম্প্রদায় যাকে রোমান ক্যাথলিক বলা হয়। রোমান ক্যাথলিক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। তিনি একজন রোমান ক্যাথলিক চার্চের যাজক/ পাদ্রী ছিলেন। তিনি প্রায় তৃতীয় শতাব্দীতে রোমে বসবাস করতেন। তৃতীয় শতাব্দীতে রোমের একজন সম্রাট ছিলেন যার নাম ক্লোডিয়াস দ্বিতীয়। তাঁর শাসনামলে তিনি মনে করতেন বিবাহিতা পুরুষ সৈনিক জন্য উপযুক্ত নয়। তাই তিনি তরুণ সৈনিকদের বিয়ে নিষেধাজ্ঞা আদেশ জারি করেন। তখন রোমান ক্যাথলিকদের থাকে চার্চের পাদ্রী সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এই আদেশ অন্যায় মনে করেন। তাই সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এই আদেশ অমান্য করে, গোপনে তরুণ সৈনিকদের বিয়ে দিতেন। যখন সম্রাট ক্লোডিয়াস দ্বিতীয় এই কথা জানতে পারেন, যে তাঁর আদেশ একজন পাদ্রী অমান্য করে সৈনিকদের বিয়ে দিচ্ছে। তখন তিনি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে কারাগারে বন্দী করেন এবং অবশেষ সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড আদেশ দেন। বলা হয় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন যখন কারাগারে ছিলেন, তখন জেলারের একজন মেয়েকে ভালোবাসতেন। ওই মেয়েটির নাম জুলিয়াস বলে যানা যায়, যেই মেয়েটি জন্মান্ধ ছিলেন। যাকে রোমান ক্যাথলিক চার্চের পাদ্রী সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নাকি ভালোবাসতেন।
কথিত আছে যে, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন জেলারের ওই জন্মান্ধ মেয়েটির দৃষ্টিশক্তি প্রার্থনার মাধ্যমে ফিরিয়ে আনেন। মৃত্যুর আগে তিনি ওই মেয়েটিকে একটি চিঠি লিখেন, চিঠিতে এইভাবে লেখা ছিল “ইউর ভ্যালেন্টাইন” ইতি “তোমার ভ্যালেন্টাইন”। এই ঘটনাটিই থেকে ভ্যালেন্টাইন ডের পালনের প্রথার সূচনা হয়।
2. রোমানদের প্রাচীন উৎসব লুপারকালিয়া।
ভ্যালেন্টাইন ডে'র পালন করার আরেকটি উৎস বলা হয় রোমানদের প্রাচীন উৎসব “লুপারক্যালিয়া”। এই উৎসবটি সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাসে ১৩ তারিখ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত পালন করা হয়ে থাকে। এই উৎসবটি তাদের কৃষি দেবতা লুপারক্যালিয়ার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছিল, যিনি ছিলেন তাদের দেবতা। রোমানরা এইসব সময় ছাগল ও কুকুর বলি দিত এবং তারপর তাদের মধ্যে দুজনকে বেদীর কাছে নিয়ে যাওয়া হতো। তাদের কপালে একটি রক্তাক্ত ছুরি দিয়ে স্পর্শ করা হত এবং দুধে ভেজা পশম দিয়ে রক্ত মুছে ফেলা হতো। প্রথা ছিল এই সময় উভয় যুবককেই হাসতে হবে। এরপর একটি কোরবানির ভোজ অনুষ্ঠিত হত, যার পরে “লুপারসি” বলিদানের পশুর চামড়া থেকে টুকরো কেটে প্যালাটাইন পাহাড়ের চারপাশে দুইজনের দল হয় দৌড়াতেন, এবং সেই সময় তাদের কাছে আসা যেকোনো মহিলার দিকে সেই টুকরো ছুঁড়ে মারতেন। এটা বিশ্বাস করা হত যে পশুর চামড়া থেকে টুকরো ফলে নারীর প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতো। সাধারণ কথায় বলা যায় যে, একজন মহিলার গর্ভধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এই উৎসবের উৎপওি অস্পষ্ট।
মনে করা হয় এই লুপারক্যালিয়ার শব্দ লুপাস থেকে আগত যেটি ল্যাটিন ভাষায় বাংলায় “নেকড়ে” বোঝায়। তবে বলা হয় ওই রোমান দেবতা নেকড়ে'দের হাত থেকে পুশুপাল রক্ষা করেছিলো। উর্বরতার একটি রীতি হিসেবে, এই উৎসবটি দেবতা “ফাউনাসের” সাথেও যুক্ত করা হয়ে থাকে। এটি ছিল উর্বরতা ও বসন্তের আগমন উদযাপনের একটি উৎসব। এই উৎসবে নারী ও পুরুষরা লটারির মাধ্যমে জুটি বাঁধতেন এবং উৎসবের শেষ পর্যন্ত একসাথে থাকতেন। কিছু ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক স্থায়ী হতো এবং তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতেন।
৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে পোপ অধীনে, পোপ গেলাসিয়াস প্রথম লুপারকালিয়া উৎসব বন্ধ করে দেন। এবং ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের স্মরণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন দেন। যেহেতু খ্রিস্টানদের মধ্যে তখন প্রভাবশালী ভাবে রোমান ক্যাথলিক ছিলো, তাই রোমান ক্যাথলিক ধর্মের প্রভাবে এই দিনটি প্রেম ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে হয়ে উঠে।
ভ্যালেন্টাইন ডে সপ্তাহ কি কি?
নং | তারিখ | দিন |
---|---|---|
১. | ৭ ফেব্রুয়ারি | রোজ ডে |
২. | ৮ ফেব্রুয়ারি | প্রপোজ ডে |
৩. | ৯ ফেব্রুয়ারি | চকোলেট ডে |
৪. | ১০ ফেব্রুয়ারি | টেডি ডে |
৫. | ১১ ফেব্রুয়ারি | প্রোমিজ ডে |
৬. | ১২ ফেব্রুয়ারি | হাগ ডে |
৭. | ১৩ ফেব্রুয়ারি | কিস ডে |
৮. | ১৪ ফেব্রুয়ারি | ভ্যালেন্টাইন ডে |
ভ্যালেন্টাইন ডে কেন পালন করা হয়?
ভ্যালেন্টাইন ডে পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো ভালোবাসা প্রকাশ করা। এই দিনটি মানুষকে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে এবং সম্পর্ককে আরও গভীর করতে উৎসাহিত করে। ভ্যালেন্টাইন ডে এটি শুধুমাত্র প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং পরিবার, বন্ধু এবং কাছের মানুষদের মধ্যে ভালোবাসা ও স্নেহ বিনিময়ের একটি সুযোগ। উদাহরণস্বরূপ পালন করার কিছু কারণ যেমন ধরুন;
- প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য
- বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের জন্য
প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য
ভ্যালেন্টাইন ডে প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য একটি স্পেশাল দিন। এই দিনে প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অপরকে উপহার, ফুল, চকলেট এবং গ্রেটিং কার্ড দিয়ে তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে। অনেকেই এই দিনটি রোমান্টিক ডিনার বা ভ্রমণের মাধ্যমেও পালন করে থাকেন।
বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের জন্য
ভ্যালেন্টাইন ডে শুধুমাত্র যে প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রেমের সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ তাও কিন্তু নয়। এই দিনটি বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভালোবাসা প্রকাশ করার একটি সুযোগ বলা যায়। তো অনেকেই এই দিনে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সময় কাটান এবং তাদেরকে ছোট ছোট উপহার দিয়ে থাকেন।
ভ্যালেন্টাইন ডের আধুনিক উদযাপন
আধুনিক সময়ে ভ্যালেন্টাইন ডে বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে পালন করা হয়। এই দিনটি বাণিজ্যিকভাবে খুবই ইম্পর্টেন্ট হয়ে উঠেছে। তা ফুল, চকলেট, কার্ড এবং বিভিন্ন ধরনের উপহারের বিক্রি এই দিনে ব্যাপকভাবে ক্রমশ বেড়েয় চলেছে। ভ্যালেন্টাইন ডের আধুনিক সময়ে যেভাবে উদযাপন করার হয় উদাহরণস্বরূপ;
- উপহার দেওয়া
- রোমান্টিক ডিনার
- ভ্রমণ করা/ ভ্যাকেশনে যাওয়া
উপহার দেওয়া
ভ্যালেন্টাইন ডে'র সময় উপহার দেওয়া একটি বড় অংশ হয়ে উঠেছে। এই দিন প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অপরকে তা ফুল, চকলেট, জুয়েলারি, মোবাইল এবং অন্যান্য রোমান্টিক উপহার দিয়ে থাকেন। অনেকেই আবার এই দিনে হ্যান্ডমেড কার্ড বা ব্যক্তিগত উপহার তৈরি করে নিজের প্রিয়তম/ প্রিয়তমার কাছে ভালোবাসা প্রকাশ করে থাকে। নিজের সাধ্যমত যে যেটা পারে তা নিজের প্রিয়তম/প্রিয়তমাদের উপহার দিয়ে থাকেন।
রোমান্টিক ডিনার
অনেকে এই দিন অর্থাৎ Valentine's Day -তে নিজের প্রিয়তমাদের ইমপ্রেস করার জন্য রেস্তোরাঁগুলোতে রোমান্টিক ডিনারের আয়োজন করে থাকে। তাছাড়া আবার অনেকেই যারা নিজের পরিবারকে খুব ভালোবাসে তারাও একই ভাবে দিনটি রেস্তোরাঁতে ডিনার মাধ্যমে পালন করেন।
ভ্রমণ করা/ ভ্যাকেশনে যাওয়া
অনেকে এই দিনে নিজের প্রিয়জনদের সাথে বিশেষ একটি সময় যা তাদের স্মৃতিস্বরূপ হয়ে ওঠার জন্য ভ্যাকেশনে যাওয়ার ছোট একটা পরিকল্পনা করে থাকেন। যেখানে তারা নিজেদের অনেক সময় দিয়ে থাকেন।
ভ্যালেন্টাইন ডের সমালোচনা
ভ্যালেন্টাইন ডে বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশে পালন করা হয়ে থাকে। এই দিন উদযাপন নিয়ে যেমন পজেটিভ মনোভাব লোক রয়েছে, ঠিক একই ভাবে নেগেটিভ মনোভাব লোক ও রয়েছে তাই এই দিন উদযাপন করা নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে। কিছু মানুষ মনে করেন যে এই দিনটি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। যুবসমাজকে বিয়ে করার করার আগে অন্যজনের সাথে সময় কাটাতে দেওয়া উচিত নয়। যুবসমাজ প্রতি ভালোবাসা সঙ্গ দেওয়ার ফলে দিনের পর দিন নানা অবৈদ্য সম্পর্কে জড়িত হয়ে ওঠে সন্তান নষ্ট করা হচ্ছে। অর্থাৎ বিবাহিতা হয়ার আগে কুমারী নারীরা গর্ভবতী হয়ে উঠছে। এছাড়াও অনেকে বলে এই বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছে তাই তারা মনে করেন যে ভালোবাসা প্রতিদিন প্রকাশ করা উচিত, শুধুমাত্র একটি দিনের জন্য নয়।
উপসংহার
ভ্যালেন্টাইন ডে হল ভালোবাসা, স্নেহ এবং সম্পর্কের উদযাপনের একটি বিশেষ দিন। এর ইতিহাস প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য এবং খ্রিস্টীয় ধর্মের সাথে জড়িত। যদিও এই দিনটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়, তবুও এর মূল উদ্দেশ্য হলো ভালোবাসা প্রকাশ করা এবং সম্পর্ককে আরও গভীর করা। ভ্যালেন্টাইন ডে শুধুমাত্র প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য নয়, বরং পরিবার, বন্ধু এবং নিজের জন্য ভালোবাসা প্রকাশেরও একটি সুযোগ। এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে ভালোবাসা হলো জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সুন্দর অনুভূতি।
0 মন্তব্যসমূহ